সাগরিকা রায়-এর ব্লগে আপনার স্বাগতম .

মনোবাঞ্ছা

মনোহরপুরের কালী মন্দিরে ঢুকে মা কালীর সোনার চোখদুটো চুরি করেছিল। তারপর থেকেই নাকি মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে বদন সরকারের। এমন কিছু দৈব। এব্যাপারস্যাপার এর পিছনে কাজ করেছে, এমন নয়। যদিও জ্যোতিষী সরল ঘোষ বদনের হাবভাবের সঙ্গে মন্দিরের চুরির একটা যোগসাজশ ঘটিয়ে ফেলেছে। জামাই প্রতাপকে সে কথাই বলছিল সে, ‘হঠাৎ করে মাথা খারাপ কেন? ভেবে দেখেছ কি? এর পিছনে আছে এক ভয়ানক অভিশাপ। আরে, দেবীর চোখ চুরি কি সাধারণ ঘটনা? বংশের পর বংশ এই অভিশাপে জর্জরিত হবে, দেখে নিও।’ সরল ঘোষবাড়িতে গিন্নিকে বলেছেন, ‘আরে ধুর। ওসব অভিশাপ-টাপ বাজে কথা: ওগুলো বিশ্বাস করিয়ে আখের গোছাতে হয়। চোরের আবার মাথা খারাপের জন্য কারণ লাগে। চুরি করাটাই তো মাথা খারাপের লক্ষণ।’ ‘তাহলে বদনই চোর?’ প্রতাপ উৎসাহিত। কেউ অপরাধ করে ধরা পড়ার জায়গায় চলে এলে সকলেই বেশ খুশি হয়। একটা বলার মতো কথা কিনা। চোরের দিকে আঙুল তুলে, আঙুল তুলে, ‘ওই চোর, ওই চোর’ বলার মধ্যে কীয়ে আয়াতৃপ্তি আছে, কেউ না জানুক, অন্য কেস-এ জড়িয়ে পড়া অন্য চোরও সেটা জানে। তাছাড়া চোর বলে বদনের সুনাম রয়েছে। তাতে কালী কেন দায়ী হবেন? বদনের মাথা সেই ছোট থেকেই নড়বড়ে। কেনা জানে সেকথা। তো প্রতাপ ডুয়ার্সের হাটে ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সে কথাই ছড়িয়ে দিচ্ছিল বেশ রসিয়ে। রোববার করে জমিয়ে হাট বসে মনোহরপুরে। কত কিসিমের মানুষ যে আসে, তার আর ঠিক নেই। নাগারু রাভা বলেছিল, প্রতাপকে অজগরের বাচ্চা এনে দেবে। যে বাচ্চার মাথায় সরষের সাইজের মণি আছে বাদামি রজের। দুই হপ্তা ধরে নাগারর খোঁজে ঘুরে যাচ্ছে সে। এদিকেন । এদিকে নাগারর পাত্তাটি নেই। মেন্দাবাড়ি থেকে আসে সে। এদিকে কয়েকদিন ধরেই নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। ভান্ডানি নদীতে জল উপচে পড়ছে। হয়তো নাগাক্ত আসতে পারছে নানদী পেরিয়ে। প্রতাপ নাগারা খোঁজেই এসেছিল হাটে। নাগারুর ফোন নাম্বার আছে। ফোন করে করে ছেদিয়ে পড়েছে প্রতাপ। কিন্তু নাগারু ফোন ধরছেনা। ভিডিও হলের পাশ দিয়ে চালের হাটের দিকে যাচ্ছে প্রতাপ। নাগারুর কুটুম সেখানে আসে চাল নিয়ে। সে কোনও খবর দিতে পারে কিনা দেখতে এসে প্রতাপ অবাক। চাল হাটে বসে আছে বদন। রাশি রাশি। শ চালের বস্তার এক কোণে চুপ করে বসে আছে। কেন? কুটুমকে দেখে জোরে জোরে কালীর চোখ চুরির ঘটনা বলতে থাকে প্রতাপ। মাঝে মাঝে জর্দাপান চিবিয়ে নেয়। বদনের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারে, প্রতাপের সব একথাই গুনেছে সে। ইচ্ছে করে কুটুমসহ আর পাঁচটা বেপারিকে শুনিয়ে সাবধান হতে বলে প্রতাপ, ‘দেখ বাপু, চালের বস্তা উঠিয়ে নে’ যেতে পারে কিন্তু। তোমরা অন্যমনস্ক হয়েছ কি অমনি চোর হাওয়া। আরে, জাগ্রত কালীর চোখ চুরি করেছে। মা কালী কি ছেড়ে দেবে। কালীকে যতই পটাও, কালী কিছুতেই পটবে না। তবে হ্যাঁ, কালীর খাঁড়াটা এক্কেরে সোনার, সেটা যে নেয়নি, এই বলে কত!’ এতক্ষণ ধরে অন্যের মুখে নিজের কীর্তিকলাপ শুনতে শুনতে একটু একটু লজ্জার সঙ্গে। * ঘুমও পাচ্ছিল বদনের। মনে হচ্ছিল, মা কালীর চোখ চুরি করাটা ভালো কাজ হয়নি। কিন্তু প্রতাপ যেইনা বলেছে, খাঁড়াটা সোনার, অমনি বদনের মাথায় বুনো জ্বলে উঠল। খাঁড়া সোনার নাকি? এ বাবা। বড্ড ভুল হয়ে গেল দেখি। অনেকদিন ধরেই চোখে ঝাপসা শ্বশুরের অবর্তমানে নিজের পদোন্নতির কথা ভেবে ফেলে। যেটা রোজ রাতেই ঘুমোনোর আগে একবার করে ভাবে বলে নতুন করে ভাবতে হয় না। খুব সহজেই ছবিটা চলে আসে চোখের সামনে। প্রতাপ শ্বশুরের বড় চেয়ারে বসে লম্বা কাপে চা খাবে। পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে প্রিয়াঙ্কা। চারপাশে লোকজন হাতজোড় করে থাকবে। আহা। কী সিন মাইরি। নাগারু বিরক্ত চোখে হাত বাড়ায়, ‘ক্যাশ? দাও। কিন্তু, সাপ দিয়ে করবে কী? অবশ্য আমার জেনে লাভ নেই। মাল এখন তোমার হাতে। বাচ্চুর মালিক তুমি।’ বাচ্চু। ও, বাচ্চাকে আদর করে বাচ্চু বলছে নাগারু। প্রতাপ হেসে পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে দিতেই নাগারু হাটের দিকে দ্রুত হেঁটে যায়। প্রতাপের হাতের মধ্যে কালো ক্যারিব্যাগের ভিতরে কী যেন খলবল করে। বাবারে। এটা ব্যাগ ফুটো করে প্রতাপকেই কামড়াবে না তো? প্রতাপ ব্যাগটা অন্য আরেকটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। প্রিয়াঙ্কার বড্ড বাড় বেড়েছে। দেবে একদিন সাপ ছেড়ে ওর গায়ের ওপরে। তারপর প্রিয়াঙ্কার বোন দীপিকাকে বিয়ে করবে। সেকী? ‘নতুন বউ’ আসবে জীবনে? ওহ মা রে। এমন দিন কি হবে মা তারা। প্রতাপ তো এটা আগে ভেবে দেখেনি। দীপিকার স্কুলের নাম দীপালি হলেও প্রতাপ নিজেই মনে মনে দীপিকা রেখেছে। সেই দীপিকা ওর জীবনে আসতে পারে ভেবে মন খুলে দিয়েছে প্রতাপ হাটের উলোঝুলো বাতাসে। প্রতাপের ভুলো মন। মনের কথা জোরে উচ্চারণ না করে ভাবতে পারে না। সে খেয়ালই করেনি, বটের অন্য পিঠে চুপটি করে এ দাঁড়িয়ে কালো ব্যাগের রহস্য এবং প্রতাপের মনোবাঞ্ছা জেনে ফেলেছে চোখ-চোর বদন সরকার। জানা ইস্তক কেমন এক আলাতুলা ভূত পিঠে উঠে বসে মাথায় চাপতে চেষ্টা করে চলেছে। সব ফাঁকা ঠেকছে। মনে হচ্ছে, মনোবীণার কোলে মাথা রেখে খুব কাঁদে। মনোবীণা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলবে, ‘ভালো হয়ে যাও কদন। আর কেঁদোনা। চারপাশে অনেক খারাপ লোক। তুমি কেন ওদের মতো হবে?’ দেখছে। কিন্তু কালীর চোখ দুটো বেশ স্পষ্টই দেখতে পেয়েছে সে রাতে। তাহলে চক্রবর্তীবাবুর মেয়ে মনোবীণা কেন ওকে কানা বলে টিটকিরি দেয়। হতে পারে মনোবীণাকে দেখে ওর প্রাণে বাতাস বেশি খেলে, তাই বলে টিটকিরি। আর সেটাকেই সত্যি মনে করে নিজেই চোখে কম দেখে ভেবে ফেলেছে বদন? সোনার খাঁড়া। সহজ কথা। প্রতাপ উঠে যাবে যাবে করছে, ঠিক সেই সময় নাগার এসে হাজির। হাতে প্লাস্টিকের কালো রঙের ব্যাগ। হয়তো ওতেই আছে অজগরের বাচ্চা। প্রতাপ শিউরে ওঠে। বউ প্রিয়াঙ্কা এতদিনে বরকে ভক্তি ক্যাবে তাহলে? মোটে পাত্তা দেয় না। ঘরজামাই বলে। সাপের বাচ্চাকে পোষ মানিয়ে নেবে প্রতাপ। মালিকের আদেশ মানবে সাপকুমারী। প্রতাপকে আর একবার ‘ঘর জামাই’ বলে দেখুক প্রিয়াঙ্কা। সেই কবে থেকে প্রিয়াঙ্কাকে চেনে বদন। দেখ, চুপিসারে একটা খুন হতে যাচ্ছে। কাকে বলবে বদন এই কথা? কে শুনবে? ওকে দেখলেই লোকে ঘটিবাটি সামলায়। ঘরে ঢুকতে দেয় না। এই তো সেদিন, মন খারাপ লাগছিল বলে ছেলেবেলার বন্ধু তপুর কাছে গিয়েছিল। তপু বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফেনা তুলে দাঁত ব্রাশ করছিল। ওকে দেখে ফক করে ফেনা ছুঁড়ে ফেলল জবা গাছের গোঁড়ায়, ‘কী চাই?’ ‘কিছু না। কেমন আছিস…।’ বদন মিইয়ে যায় তপুর ব্যবহারে। ‘আমরা ভালোই আছি। এখন যা।’ ফের ব্রাশ মুখে ঢুকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা মুখের ওপরে বন্ধ করে দিয়েছে তপু। বদনের মনে আছে সব। মনে থাকে সব। বিকেলের রোদ নিভে এল একসময়। হাটের একধারের চোলাইয়ের ঠেকে লুকোবুকো করে কিছু মানুষ আসতে শুরু করেছে। বদন হেঁটে মনোবীণাদের বাড়ির সামনের পাকুড় গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে উকিঝুঁকি দিয়ে বাড়ির ভিতরটা দেখার জন্য গলা বাড়াচ্ছিল। দেখল, মনোবীণাদ্দের বাড়ির সামনে প্যান্ডেল বাঁধার আয়োজন হচ্ছে। কী ব্যাপার। এত রঙচতে কাপড় চোপড় দিয়ে কী হচ্ছে। দুটো লোক রঙিন ফুলের ঝালর একদিকে গুছিয়ে রাখছে, তারা বদনকে দেখে অবাক, ‘কে হে?’ নাগাক ইশারায় ব্যাগ দেখিয়ে আড়ালে যেতে বলল প্রতাপকে। প্রতাপ বটগাছের আড়ালে যেতেই নাগারু চলে এল, ‘সাপ কিনা বুনো। বনের জন্তু চুরি করলে জেল হয়ে যাবে। তোমার জন্য অনেক কঠিন কাজ করেছি। কত দেবে? টাকা এনেছ?’ ‘এনেছি। দুশো টাকা। এর বেশি হবে না। হাতে টাকা এলে ঠিক খুশি করে দেবো একদিন।’ প্রতাপ হালকা করে বদন । নিজের পরিচয় দিল। না, ‘কী হবে এখানে।’ ‘বিয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে। আলিপুরদুয়ারের বর। বড় চাকরি করে।’ একজন ঝালরের ফুল সেট করছিল। কদন অনেকক্ষণ ধরে এদিক ওদিক হেঁটে হেঁটে বেড়ালো।

কী যেন নেই, সে যেন ছিল না। কে যেন আসবে, সে কেন এল না, এমন এক আলাভুলা ভূত মাথায় চেপে বসে আছে। তার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে আছে বদনের ঝাঁকড়া চুল, যাতে পড়ে না যায় টুক করে। বদন তাকে নামাতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে হেঁটেই বেড়ায়। এক সময় কালী মন্দিরের কাছে এসে চুপ করে দাঁড়াল। তারপর, চব্বিশটা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে কালীর সামনে এসে দাঁড়াল যখন, তখন মন্দিরের সামনের ছোট বালবের আলো টিকটিক করছে। মোটা মোটা লোহার রডের ভিতরে দেবীর মুখ অল্প দেখতে পাচ্ছে বদন। চুরির পর একটা নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে আর কী! মন্দিরটা কেমন এক রকম নিশ্চুপ থেকে বদনকে দেখছে। তার সারা গায়ে ধুনোর গন্ধ। বদন শ্বাস ফেলে। এসব বেষ্টনীর ভিতরে যাবে কেন ও? পিছনের ছোট দরজা রয়েছে। সেটার কথা কেউ মনে রাখে না। সেই দরজায় তালা আছে। সেটাও বাধা হল না বদনের কাছে। ছোট্ট থেকেই শেখা এই কাজ। কে শিখিয়েছিল, তা আর মনে নেই। কিছুই মনে থাকে না। কানা হয়েই কাটিয়ে দিল জীবনটা। শুধু একরাশ ফুলের ঝালরের ফ্রেমের মধ্যে মনোবীণা উঁকি দিয়ে হেসেই চলেছে আজ, সেই ছবিটাই দেখতে পাচ্ছে। পিছনের দরজা টুক করে খুলে মন্দিরের ভিতরে ঢুকেছে বদন। মা কালী কি ওকে দেখতে পাচ্ছেন? লালপেড়ে শাড়ি পরে শূন্য চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না! আচ্ছা, কালী নাকি কিছুতেই পটে না? সত্যি নাকি? পকেট থেকে কাগজে মুড়ে রাখা সোনার দুটো চোখ বের করে বদন। ঘটের জল চোখের পিছনে অল্প লাগিয়ে নিল। তারপর, কালীর শূন্য চোখের মধ্যে চোখদুটো আটকে দিল ও। এখন কালীর মুখ ঝকঝক করছে। সেই মন খারাপের চেহারাটাই নেই আর। বদন হাতজোড় করে, ‘অনেক খারাপ হচ্ছে। সেসব একটু দেখো। প্রতাপের মাথা থেকে সাপটা বেরিয়ে যেন বনের ভিতরে ওর মায়ের কাছে চলে যায়। আর, আলিপুরের লোকটি যেন ভালো রাখে মনোকে। এটুকুই বাঞ্ছা আমার। চোখ দিয়ে গেলাম। দেখ সব। আর কিছু না।… যাই গো।’ চব্বিশটা সিঁড়ির ধাপ ভেঙে নেমে যাচ্ছে বদন সরকার। দেখতে পায়নি, পিছনে, মন্দিরের ভিতর থেকে একজন উঁকি দিয়ে ওকে দেখছিল। তাঁর লালপেড়ে শাড়ির এটুখানি দেখা যাচ্ছিল। না তাকালেও অনেক কিছু দেখা যায়। বদন জানে মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে। কালী চোখ ফেরত পেয়ে বেশ পটে গিয়েছে। এখন সব দেখতে পাচ্ছে। নিশ্চয়।

দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকার রবিবাসরীয়
Prev post
ভূত বা ভয়
Next post
অমলতাস

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Select the fields to be shown. Others will be hidden. Drag and drop to rearrange the order.
  • Image
  • SKU
  • Rating
  • Price
  • Stock
  • Availability
  • Add to cart
  • Description
  • Content
  • Weight
  • Dimensions
  • Additional information
Click outside to hide the comparison bar
Compare
Cart

No products in the cart.